কার্তিকের কুয়াশা

 

নীড়ের স্বপন

ফিরোজা হারুন

নীহারিকা। সুদূরের পিয়াসী। কবিতার শ্রী মাখানো নাম। নামটি চয়ন করেছিলেন তার মাতা রাবেয়া খাতুন। ছোটবেলা হতেই কেন যে এত ভূগোল প্রীতি ছিল তাঁর, কে জানে! ভূ-পৃষ্ঠে সাগর, সমতল ভূমি, পর্বতমালা, বনভূমি তাকে খুব আকর্ষণ করতো। সাগরের মাঝখানে সাগর-নাম তার শৈবাল সাগর-তাকে পুলকিত করত। ভূগোল বিষয়কে অন্য মেয়েরা খুব ভয় করতো। দোয়া-দরুদ পড়ে পরীক্ষার হলে যেত। রাবেয়া খাতুনের সে দিনটি হতো আনন্দের দিন। একদিন স্কুল লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখে কত প্রকার ভূগোল বই! এত ভূগোল বই দেখে সে হতবাক হয়। প্রাকৃতিক ভূগোলের উপর আস্তা একখানি বিরাট গ্রন্থ। বইটি খুলে দেখে, বিশ্ব ব্রক্ষান্ধে অপূর্ব তথ্য সমৃদ্ধ একটি জগৎ। আনন্দে নেচে উঠে তার চিত্ত। বইটি হোস্টেলে নিয়ে এসে আদ্যোপান্ত পাঠ করে। মহাকাশ সম্বন্ধে তার প্রচন্ড কৌতুহল জন্মায়। সে ভাবে এই দৃশ্যমান নীহারিকাপুঞ্জ কোন কল্পনার বিষয় নয়-বাস্তব। ওখানে কি আর, কেমন তারা? আরোর ঝর্ণার মতো জ্বলজ্বল করছে।

নীহারিকা শব্দটি রাবেয়া খাতুনের খুব পছন্দ। কতবার যে খাতার পাতায় লিখতো-যেন অন্তরে বিধৃত একটি শব্দ। পরবতী জীবনে কেন সে নিজেও জানে না তার প্রথম কন্যার নাম রাখলো নীহারিকা। তার প্রিয় শব্দটি বাস্তবে কন্যারূপে কায়া ধারণ করলো। তার জীবনে এ এক পরম পাওয়া।

ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে নীহারিকা। পরিচিতি লাভ করে মেধাবী ছাত্রী হিসাবে। মেধায় মননে, শিষ্টাচার নম্রতায়, সে একজন চৌকস মেয়ে হিসাবে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে সে বিদ্যালয় সমূহের চৌকাঠ অতিক্রম করে বেরিয়ে আসে কর্মজীবনের আকাংখায় শিক্ষাজীবনের শেষে কর্মজীবন। তার মাঝখানে আরেকটি ধাপ আছে মেয়েদের জীবনে। সেটি হচ্ছে উদ্বাহের বন্ধন।

বছর দেড়েক চাকুরী করবার পরই নীহারিকার জন্য সুপাত্রের সন্ধান মেলে। পাত্রটি আর কেউই নয়, নীহারিকার পিতার প্রিয় বন্ধু আবুল কাশেমের জেষ্ঠ্যপুত্র নাইমূল হক, উজ্জ্বল। এম এ পাস করে চাকরীরত। সরকারী চাকরী। একদিন উচ্চতর পদে অধিষ্ঠিত হবে আশা করা যায়। উজ্জ্বলতার প্রতীক বটে! তবে অন্তরটি যেন একটু আঁধারে আচ্ছন্ন।

নীহারিকার অতশত চিন্তা-ভাবনা নেই বিয়ের ব্যাপারে। কারণ পাত্র তাদের পরিচিত। বিশেষ করে পিতার বন্ধু পরিবার। সজ্জন হবে সন্দেহ নেই। দিনক্ষণ নিরীক্ষণ করে বিবাহ কার্য সমাপনান্তে পাত্রী চলে গেল শ্বশুরালয়ে। ভাল কাটলো এ বাড়ি ও বাড়ি বেড়িয়ে, মোগলাই খানা খেয়ে। কিন্তু কোথায় যেন ফাঁক দেখা যায়। নীহারিকার উজ্জ্বল স্বামীর সিগারেট প্রীতি তার মোটেও ভাল লাগে না। শুধু সিগারেট প্রীতিই নয়, অনেকটা নির্লিপ্তভাব তার অনুভূতিকে সচেতার করে তোলে সে মাঝে মাঝে শুধায় নানা কথা, নানা ছলে। কখনও উত্তর মেলে, সন্তোষজনক নয়। কখনও জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। কিছুদিনের মধ্যে ঘোষণা করা হয় নীহারিকা আর চাকুরী করতে যাবে না। নীহারিকা এবার সত্যি আকাশ থেকে ভূপাতিত হয়। চাকুরীতে কেন যাবে না, তার কারণ পরিবারে রেওয়াজ নেই।

এই কিছুকাল আগেও মেয়েরা লেখাপড়া করতে তেমন একটা বাইরে যেত না। এখন যায়। প্রচুর মেয়েরা অফিস আদালতে চাকুরী করছে। রাজনীতি করছে, দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করছে। রেওয়াজ ছিল না, এখন রেওয়াজ হয়েছে। বাধাটা কেন? কারণ যুক্তিসঙ্গত হতে হবে। তবেই চাকুরী ছাড়া যেতে পারে। স্বামী বললেন-এত জজ-ব্যরিস্টারের ওকালতির প্রয়োজন নেই। হুকুম মানে হুকুম- মানতে হবে।

পিতার বন্ধুর পুত্র! পিতার বন্ধু বললেন ঝামেলার দরকার কি? চায়না যখন তখন না করাই ভাল। তাছাড়া দুদিন পরে সংসার বাড়বে, দ্বায়িত্ব বাড়বে। সেটাই বা চাকুরীর চাইতে কম কি? নীহারিকার চক্ষু ছানাবড়া। অফিসে খবরটি প্রকাশ করামাত্র সকলে মর্মাহত হয় বলে, আপনার মত একটি মেয়ে চাকুরী করবে না, তবে কে করবে? এমন অযৌক্তিক ভাবনা কোন ভদ্র শিক্ষিত পরিবারের হতে পারে না। আপনি তাদের বুঝিয়ে বলেন। কিন্তু নীহারিকা জানে সংসার রাখতে চাইলে চাকুরী রাখা যাবে না। চিত্ত বড়ই বিক্ষুব্ধ হয়। তার বন্ধু রেহানা বললো, দেখিস তোকে আবার চাকুরীর আশ্রয় নিতে হবে। যে তোর মত মেয়েকে চাকুরী করতে দিচ্ছে না, বিনা কারণে, সে তোর কোন আপনজন নয়। তোকে দুঃখ আর বিপদে ফেলার জন্য তার প্রভুত্বের অধিকার ব্যবহার করছে মাত্র। সে তোর কেউ নয়¬Ñ কথাগুলো মনে রাখিস আর প্রয়োজনমত কাজে লাগাস।

ভগ্নহৃদয়ে নীহারিকা বাড়ি ফিরে এলো। স্বামী খোঁজ নিলেন চাকুরী ত্যাগ করা হয়েছে কিনা। মুখে তার ক্রুর হাসি ফুটে উঠে। এবার শুরু হবে তার আসল খেলা। নীহারিকার নয়নযুগল ভরে উঠে জলে। নীহারিকা তার প্রশ্রয় দেয় না। সে সিদ্ধান্ত নেয় সে আর কাঁদবে না। স্বামী ভদ্রলোক সকাল থেকে ফাই-ফরমাস খাটায়, যতক্ষণ বাসায় থাকে। মাঝে মাঝে খোটাও দেয়-বাবার পছন্দের ভাল মেয়ে বলে। নীহারিকা তর্কে যায় না। কারণ সে ইতোমধ্যে বুঝে গিয়েছে লোকটি দুষ্টু নয়-ধূর্ত স্বভাবের। গৃহকর্ম করে, সংবাদপত্র পড়ে, বইয়ের রাজ্যে আশ্রয় খোঁজে সে। তার জন্য ধমক খেতে হয়, কথা শুনতে হয়। তবে বাসার সকলে তার উপর সুখী। কারণ সে সকলের চাহিদা পূরণ করে, ভাল মার্জিত ব্যবহার করে। আর কি চাই।

এর মাঝে একদিন নাঈমের বদলির অর্ডার আসে, ঢাকায়, কুমিল্লার বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় নতুন করে সংসার সাজনোর কাজে হাত দেয় নীহারিকা। লক্ষ্য করে নাঈম তাকে কোন টাকা-পয়সা দেয়না। মোটামুটি তৈজস-পত্র ক্রয় করে সে ক্ষান্ত হয়। বাকি জিনিস- পত্র নীহারিকা নিজেই কিনে আনে। তবে খাদ্য-দ্রব্যের বাজার সে করে প্রায়ই। কারণ নীহারিকার সযতেœ রান্না করা সুস্বাদু খাবার গ্রহণে তার লোলুপ জিহ্বা বড়ই লোভাতুর থাকে। সে হিসাব রাখে কতটুকু রান্না হয়েছে, কতদিন চলবে তাতে। কুমিল্লায় থাকতে বাড়ির অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারতো, হাসতে পারতো-এখানে ওসব সুদুর পরাহত। যন্ত্রচালিতের মত কাজ করে যায়। ওকে বিষন্নতা ঘিরে ধরে। তার উপর মাঝে মাঝেই বাবার বন্ধুর ভাল মেয়ে বলে উপহাস করা-দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।

একদিন নাঈম হঠাৎ ভাল ব্যবহার করে চমক লাগিয়ে দেয়। বলে, অনেকদিন কুমিল্লা হতে এসেছে। একবার গিয়ে বেড়িয়ে এস। আমি নর্থ বেঙ্গল ট্যুরে যাব। সপ্তাখানেক লাগবে। তুমি কালই যাও, আমি পরশু যাব। নীহারিকা বলে, বাসা খালি থাকবে না?

-বাসায় কি আছে? অফিসের দারোয়ান পাহাড়া দিবে রাত্রে। চিন্তার তো কোন কারণ দেখি না। নীহারিকার পছন্দ হয় প্রস্তাবটি। ও হৃদয়, মন, আস্তা বাসার জন্য আনচান করছিল। পরদিন সে অফিসে যাওয়ার সময় একসঙ্গে বের হয়। নাইম তাকে বাসে তুলে দেয়।

কুমিল্লার বাগিচাগায়ের বাসায় ওর সময় কাটে খুব ভালো। অনেকদিন পর মনের কোনে জমে থাকা কারো মেঘের ছায়া সরে যায়। এবার ফেরার পালা। ঢাকার বাসায় ফোন করে সে। ফোন ধরে এক নারীকণ্ঠ। রং নাম্বার মনে করে আবারও ডায়াল করে। আবারো সেই কণ্ঠ। নাইমের কথা জানতে চাইলে বলে বাসায় নেই। পরক্ষণেই রিসিভার রেখে দেয়। বার বার ফোন করা সত্ত্বেও আর কারো সাড়া পাওয়া যায়নি। মনের ভিতর একটি কাঁটা খচখচ করতে থাকে। রাতে আবার ফোন করে। এবার ধরে নাইম। খুব হাসি-খুশী। বলে আজ দুপুরে এসেছি। তুমি দু’একদিনের মধ্যে চলে আস। সে দুপুরের ঘটনাটি বলতে গিয়ে বলতে পারলোনা।

খুব মন খারাপ দিনে সে ফিরে এলো ঢাকায়। এবার নাইমের মেজাজ খুব ভাল। কিন্তু বাসা অন্য একটি সুবাস, অন্য একটি আমেজের আভাস পায়। গত দশদিন এ ঘর নির্জন ছিল বলে তার মনে হয় না। বিশেষ করে শয্যা, তার প্রিয় সাজ-সজ্জার টেবিল, কেশ বিন্যাসের কাঁকুই-তাকে অনেক খবরই দিতে থাকে। নিজের আর্শিতে সে যেন কার ছায়া দেখতে পায়। নীহারিকা মানসিক সংকটে পড়ে। ভয় করতে থাকে তার। কিন্তু কোন উপায় নেই খবর সংগ্রহ করবার। ওদের বাসায় এ পর্যন্ত কোন বন্ধু-বান্ধব আসে নাই। মন ভাল থাকে না বলে সেদিকে মনযোগ দেয়নি কখনও।

নীহারিকা ভাবতে থাকে, কেবল ভাবতে থাকে। ওর অন্তরের নিগুঢ়তম প্রদেশে ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত শুনতে পায়। বলার মত কাউকে খুঁজে পায়না। তাছাড়া কেউ বিশ্বাস করবে না। এই লোককে সকলে ভাল ছেলে বলে জানে। সুতরাং কারো দ্বারে সহানুভূতির জন্য হাত বাড়িয়ে লাভ হবে না। তিরস্কার আর অবিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই মিলবে না। বিচার বিশ্লেষণ করে নীহারিকা দেখতে পায়, এ লোকের সঙ্গে সারাজীবন ঘর-সংসার করা সম্ভব হবে না। একদিন না একদিন তাকে এখান থেকে বিদায় নিতে হবে। অথবা অকালে প্রাণ হারাতে হবে। সন্দেহ আর অবিশ্বাস যেখানে বাসা বেঁধেছে সেখানে ভালবাসার স্থান নেই। একত্রে বসবাস করা প্রশ্নের অতীত। সুতরাং ‘সময় গেলে সাধন হবে না’। এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে কি করবে। যতই বেদনাদায়ক হোক, যতই অপমানজনক হোক একটি সুখের নীড়ের স্বপ্ন ত্যাগ করতে হবে। কারণ তার সারাজীবনেই কষ্টের কোন অংশীদার থাকবে না। সংগ্রাম আর অপমানের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। অপমান অপেক্ষা সংগ্রাম উত্তম।

মানুষ স্বপ্ন দেখে সুন্দর জীবনের, সুখের জীবনের। নীহারিকার ভবিষ্যত জীবনের দৃশ্য ভয়ঙ্কর আঁধারে আচ্ছন্ন। সেজন্য সে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। সংসার ত্যাগ করা ব্যতীত আর কোন পথ তার সামনে খোলা নেই। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই আবার ট্যুরে যাওয়ার বাসনা ব্যস্ত করে। ইতোমধ্যে সে স্ত্রীর সঙ্গে একজন পরিচারিকার অধিক কোন আচরণ করিনি। কি কি রান্না হবে সে বলে যায়। কত কি ব্যঞ্জন রন্ধন হয়েছে তার খোঁজ রাখে। বড় কই মাছ ভাজা একটি কম কেন, তার জন্য কৈফিয়ত তলব করে। তখন নীহারিকার অন্তরের দ্বিধা দূর হয়। তার মনোভাব দৃঢ়তা আসে। লোকচক্ষুর অন্তরালে সে একজন দুর্বৃত্তের খাঁচায় বন্দী হয়ে, ভাল মেয়ের নাম কামাবার বাসনা তার মত মেয়ের থাকতে পারে না। সিদ্ধান্তে অটল, অবিচল সে। তারপর একদিন অন্যদিনের মত সকালের কাজকর্ম শেষ করে ত্বরিত হস্তে তার ব্যাগ গুছিয়ে নেয়।

এগারটার দিকে ঘরের সব দরজা ভালভাবে টেনে রেখে সে বেরিয়ে পড়ে। কমলাপুর রেলস্টেশনে নয়, বাস স্ট্যান্ডের নয়। সোজা তেজগাঁও স্টেশনে পৌঁছে যায় একটি অটোরিক্সা ধরে। একটি ময়মনসিংহগামী লোকাল ট্রেন দাঁড়িয়েছিল। তাতেই উঠে পড়ে। পরে টঙ্গী জংশনে একটি এক্সপ্রেস ট্রেনে চড়ে রওনা হয় নীহারিকা। একটানে গিয়ে কুমিল্লা পৌঁছায়। বিনা নোটিসে বাসায় উপস্থিত হওয়ার জন্য সকলে অবাক হয়। কেন সে এসেছে সে কথাটি সে তার মাকে বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়, তার আগের অফিসের উদ্দেশ্যে। অফিস তখন ছুটি হয়ে যাচ্ছে। বড় সাহেবের দেখা পায়। তার জীবনের এহেন দুর্ঘটনার কথা বলে একটি চাকুরী প্রার্থনা করে। বড় সাহেব তার দক্ষতা ও যোগ্যতার কথা জানেন। বললেন, চাকুরী তো এ অফিসে নেই। তবে অন্য একটি অফিসে দরখাস্ত দিলে তিনি ভালভাবে রিকমেন্ড করবেন বলে আশ্বাস দেন।

নীহারিকার বিমর্ষ চেহারা বাসার সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নীহারিকা সংক্ষেপে তার বিবরণ পেশ করে। এত শীঘ্র এহেন একটি সিদ্ধান্ত নেবার আগে ভালমত চিন্তা-ভাবনা করা উচিত বলে তারা অভিমত প্রকাশ করেন। নীহারিকার এত কথা প্রকাশ করার অভিপ্রায় ছিল না। কিন্তু বাড়ির লোকেরা চাপ প্রয়োগ করতে পারে, এরকম সম্ভাবনা আছে বলেই তাকে এতসব ঘটনা বলতে হল। এবং তাকে আরও বলতে হলো যে, যাকে একটি ভাল ছেলে বলে আপনারা শুনেছেন, আর আমি একটি ভাল মেয়ে বলে আপনারা নিজের চোখে দেখেছেন। সুতরাং আমর কথা বিশ্বাস করাই আপনাদের জন্য যুক্তিসঙ্গত। বাবা বললেন, পরিবারের মান সম্মানের প্রশ্ন জড়িত-ছ্টো ভাই বোনেরা রয়েছে।

-নিজের সুখ-শান্তির কথা বাদ দিলাম, প্রাণ দিয়ে পরিবারের মান রক্ষার সনাতন চিন্তাধারা আজকের যুগে অচল। তাছাড়া এতদিনে আপনারা আমাকে যে আদর্শে মানুষ করেছেন, আজ পরের নষ্ট ছেলের ধামাধারে তা জলাঞ্জলি দেবার জন্য নয়। আমার কথাগুলি শুনতে হয়ত ভাল লাগছে না। কিন্তু বাস্তব আরো অপরিচ্ছন্ন আরো কদাকার। আজ আমি সে সব বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকতে চাই। তবে যখন সময় আসবে তখন বলবো। আর নাঈম ফোন করলে বলবেন আমি এখানেই এসছি। অন্যদিন ফোন করলে বলবেন, আমি আর ওখানে যাব না, কেন যাবনা সে উত্তরটি যেন আমার নিকট থেকে জেনে নেয়।

মুহূর্তে বাড়ির পরিবেশ থমথমে হয়ে যায়। নীহারিকার পিতা বড় বিহ্বল হয়ে পড়েন, প্রিয় বন্ধুকে কি করে এমুখ দেখাবেন!

পরদিন নীহারিকা বাইরে যায়। বন্ধু রেহানার সঙ্গে দেখা করে অফিসে। বলে বাসায় থাকতে চাই না। রেহানা বললো, আজকাল চাকুরীজীবি মেয়েরা বাড়ি ভাড়া করে নিজেরাই হোস্টেল বানিয়ে থাকে। সেখানে গিয়ে দেখি সিট আছে কিনা। ওরা দুজনে বিকেলে সেখানে যায়। একটি পরিচিতি মেয়ের দেখা পায়। সে বলে, আজই পেতে পারেন। কারণ একজন বোর্ডার আজ সন্ধ্যায় সিট ছেড়ে দিচ্ছে।

নীহারিকা বাসায় এসে মাকে বলে তার অন্যত্র বসবাসের কথা। মা রাবেয়া খাতুন ব্যাকুল হন। নীহারিকা বাসায় থাকার দরুণ পরিবারের লোকদের যে অবস্থার সস্মুখীন হতে হবে তা ব্যাখ্যা করে। তার পর তারপর তারজন্য আর চিন্তা-ভাবনা না করবার পরামর্শ দিয়ে দ্রুত রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রেহানার পরমর্শ অনুযায়ী নীহারিকা তার স্বামীর নির্যাতন, দুর্ব্যবহার এবং পরবর্তী আক্রমণের আশংকার কথা উল্লেখ করে থানায় একটি ডায়েরী করে রাখে।

এদিকে বাসায নাইমের ফোনের পর ফোন এবং নানাপ্রকার অভিযোগ আসতে থাকে। পরদিন নাইমের পিতা এসে হাজির হন বাসায়। রাবেয়া খাতুন জামাতার দুস্কর্মের কথা বলতে গেলে, তা সকলে এক বাক্যে অবিশ্বাস করেন। রাবেয়া খাতুন বলেন, সময় কথা বলবে। একদিন সব সাক্ষ্য-প্রমাণসহ আপনার সুপুত্রের কর্মকাণ্ড প্রকাশ পাবে। দোষ যদি আমার কন্যার থাকে, তাও গোপন থাকবে না। সেদিনের জন্য অপেক্ষা করুণ আপনারা।

পরদিন নীহারিকা একটি চাকুরীতে যোগদান করে। তবে আগের পোস্টের চেয়ে একটু নীচে। তাতে তার আপত্তি নেই। বড় সাহেব বলেন, পরবতীতে তার পদোন্নতির দিকে লক্ষ্য রাখা হবে।

কয়েকদিন পর নীহারিকা ছুটির একটু আগেই রেহানার অফিসে আসে-এক সঙ্গে মার্কেটে যাবে বলে। রেহানা সে সময় কোন কারণে অফিসে ছিল না। ঢুকেই দেখে নাঈম বসে আছে। নাঈম ক্রদ্ধ হয়ে তার দিকে ছুটে আসে এবং যারপরানাই গালাগাল করতে থাকে। নীহারিকা দাঁড়িয়ে তার অভিযোগ শুনতে থাকে। তারপর বলে, তোমার বক্তব্য শেষ হয়েছে? এবার যেতে পার। নাঈম উন্মাদের ন্যায় তাকে থাপ্পড় মারবার জন্য হাত তুলে। নীহারিকা ত্বরিত গতিতে তার হাত ধরে ফেলে এবং দুই-তিন চক্কর ঘুরিয়ে আনে এবং একটু বেকায়দায় হাতটি ধরেই থাকে। ব্যথায় নাঈম কোঁকিয়ে উঠে। নীহারিকা বলে, আর কোনদিন যদি আমার সামনে আস কিংবা আমাকে উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা কর, তবে তার পরিণতি এর চাইতে ভয়াবহ হবে। তোমাকে শায়েস্তা করার জন্য আমি একাই যথেষ্ট। ঢাকায় প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে আমার সংগে কি করেছ, সেই কথাগুলি একবার স্মরণ কর। দরকার হলে সেই মেয়েলোককে ধরে এনে কোর্টে হাজির করবো। তারপর বাবার বন্ধুর ভার ছেলের মুখোস উন্নোচন করে সরকারী চাকুরী করার পথটিও বন্ধ করে দিব। তুমি কি কর তা আমি জানি। এবার বল, সকলের সামনে প্রতিজ্ঞা করে যাও আর কখনও আমার সামনে আসবেনা। বলে তাকে সজোরে আরেক চক্কর ঘুরিয়ে ছেড়ে দেয়। টাল সামলিয়ে নিয়ে সে একটি টেবিল ধরে দাঁড়ায়।

নীহারিকা বলে, এসেছিলে আমাকে এত লোকের সামনে প্রহার করে আনন্দ পেতে-তোমার পৌরুষ জাহির করতে। এবার দেখ পিটুনী খেতে কেমন লাগে! শুনেছি মারের মধ্যে ভিটামিন আছে। তা তোমার কাজে লাগবে।

নীহারিকা অন্তর বরে উঠে, সাবাশ! বঙ্গ ললনা! তোমার জুডো- কারাটের প্রশিক্ষণ এভাবে কজে লাগবে তা কোনদিন ভাবতে পারিনি।

অফিসের লোকজন স্তম্ভিত হয়ে যায়। বড় সাহেব বেরিয়ে আসেন। তিনি সব শুনে সকলকে বাড়ি চলে যেতে বলেন। নাঈমকে তিরস্কার করে আর কোনদিন এহেন কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে উপদেশ দেন। অফিসে এসে এরকম সিন ক্রিকেট করার জন্য তাকে ধিক্কার দেন। ভবিষ্যতের জন্য শক্ত ওয়ানিং দিয়ে চলে যেতে নির্দেশ দেন।

নীহারিকা হোস্টেলে চলে এলো। কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারলোনা ঘটনাটা। সে নিজেকে প্রশ্ন করে বার বার। সে কি ভুল করেছে, তার কি মার খাওয়া উচিত ছিল? স্বামীর অধিকার তো প্রভুত্বের অধিকার নয়, বর্বর আচরণ করবার অধিকার নয়। সে তো মধ্যযুগের ক্রীতদাস নয়। দাসপ্রথা বহু আগেই উচ্ছেদ হয়েছে। তবে আর কেন মেয়েরা সেই অত্যাচার সহ্য করবে? কিন্তু তবুও আলোকিত জগতে এদেশের মেয়েরা অত্যাচার সহ্য করতে বাধ্য হয়। নচেৎ সে খাবে কি, যাবে কোথায়? কিন্তু নীহারিকা তো অবলা নয়। চাকুরী আছে, আশ্রয় আছে, যোগ্যতা আছে।

সন্ধ্যার দিকে চাকুরীজীবি মহিলাদের হোস্টেলের দরজায় কড়া নাড়েন নীহারিকারপিতা স্বয়ং। নীহারিকার হৃদয় প্রেকোষ্ঠে রক্ত ছলাৎ করে উঠে। এই বুঝি রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। মুহূর্তে সে নিজেকে সামলে নেয়। প্রশ্নোত্তরের জন্য প্রস্তুত হয়। পিতার প্রশ্নের পূর্বেই সে উত্তর দেয়। বলে, জানি, আপনি আমার বিচার করতে এসেছেন, পিতৃত্বের অধিকার নিয়ে। বিকেলে একজন এসেছিল স্বামীত্বের অধিকার নিয়ে। আগামীকাল আরেকজন আসবেন ভ্রাতৃত্বের অধিকার নিয়ে। আপনারা চান আমি প্রহৃত হই এবং মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যাই। তবে আমি সুকন্যা হতে পারব, আদর্শ স্ত্রী হতে পারবো। তবেই আপনারা আমাকে নিয়ে অহংকার পারবেন। বলতে পারবেন, মেয়েটি আমাদের মাটির ময়না, সাত চড়েও একটি কথা কয়না। তবে আপনারা জেনে রাখুন, ন্যায় হোক, অন্যায় হোক, কাউকে আমার গায় হাত তুলতে দেবো না। আপনি অন্তত জানেন, সারাজীবনে আমি কখনো পাপ করিনি, অসৎ কাজ করিনি, মিথ্যাচার করিনি এমনকি কটুকথাও কখনও উচ্চারণ করিনি। সেই আমি আজ হঠাৎ এমন উন্মাদের ন্যায় আচরণ করছি, কিন্তু কেন করছি? আপনার একবার ভাবা উচিৎ ছিল। এবং আমিই যে ন্যায়ের পথে আছি তা আপনার আরো আগেই বিশ্বাস করা উচিৎ ছিল। আপনার বিশ্বস্ত বন্ধুপুত্রের জন্য আপনাদের খুব মায়া হচ্ছে- কিন্তু আমার জন্য নয়। কারণ সমাজ সংসারে আমি একজন ‘মেয়ে’-দুইশত বৎসর পূর্বেকার সেই বিনোদিনী দাসী-যাকে লোকে কলঙ্কিনি বিনোদিনী বলে ডাকে- আমি সেই। যেদিন আপনার বন্ধুর তথ্যকথিত সুপুত্রের মুখোস উন্মোচিত হবে, সেদিন আপনারা কি দিয়ে নিজেদের মুখ ঢাকবেন, আমি সেই দিনটি দেখবার অপেক্ষায় থাকবো। আপনি প্রকাশ্যে আমাকে ত্যাগ করতে পারেন। তাতে আপনার পরিবারের গৌরব বৃদ্ধি পাবে, সম্মান রক্ষা হবে। আমি একটি অরক্ষণীয়া মেয়ে। আমার মান মর্যাদা রক্ষার জন্য কোন বাবা নেই, ভাই নেই, স্বামী নেই। সুতরাং আমার সম্ভ্রম রক্ষার দায়িত্ব আমারই, আর যিনি সৃষ্টি করেছেন আমাকে- তাঁর। আশা করি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন।

এই বলে নীহারিকা দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে দালানের উপরতলায় অন্তর্হিত হয়। প্রচণ্ড আবেগে শয্যায় আশ্রয় নেয়। কতক্ষণ সে কেঁদেছিল তার মনে নেই। ঘুম হতে জেগে কেমন যেন নিজেকে হালকা লাগে। সে নিজেকে স্বাধীন, মুক্ত, একই সঙ্গে রিক্ত, ছিন্ন ঘুড়ির মত মহাশূন্যে ভাসমান মনে হয়। আবার তার চোখের কোলে অশ্রুর বান ডাকে।

পরদিন নীহারিকা রীতিমত নিজের অফিসে যায়, কাজকর্ম মনোনিবেশ করে। অফিসের বড় সাহেব জেনে গিয়েছেন গতকালের ঘটনা। এসব ঘটনা তো দাবানলের মত, মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে দিকদিগন্তে।

হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো রেহানা।- কি ব্যাপারে বলতো? কম্পিত কণ্ঠ তার, বড় দ্রুতলয়ে উঠানামা করছে। নীহারিকা বললো কি শুনেছ জানিনা। আমার নিকট থেকে একবার জেনে রাখ, তবে আর দ্বিধায় পড়তে হবে না তোমাকে। সব শুনে রেহানা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বলে, এর চাইতে উচিত কাজ আর কিছুই হতে পারে না। আমি তোমার সঙ্গে আছি। যে কোন বিবেকবান মানুষই তোমাকে সাপোর্ট করবে। নীহারিকা প্রশ্ন করে, বিবেকবান? আমার বাবার চাইতে আর কে আছে? কোথায় আছে? আর সাপোর্ট? লোকে সুযোগ বুঝে সাপোর্ট করে। যে দিকে ছাতা ধরলে নিজের গা বাঁচানো যায়, সেই দিকে ছাতা ধরে। এসব ভাল ভাল বচন গত কয়েক মাসে আমার জানা হয়ে গেছে। কারণ আমাদের বাসার লোকেরা আমার ব্যাপারে একেবারে অজ্ঞ ছিল না। কেউ আমাকে উৎসাহ বা তথাকথিত সমর্থন দেয়নি। যে মা কাব্য করে মেয়ের নাম রেখেছিলেন তার চোখে জল দেখেছি- মুখের কোন কথা শুনিনি। কারণ একটিই- তিনিও একজন মেয়ে, একজন আদর্শ গৃহীহিনীর মর্যাদার আসীন আছেন এবং থাকতে হবে। আকাশে কত অগণিত নক্ষত্র আছে। সেখান থেকে যদি একটি তারা খসে পড়ে, তবে আকাশের কোন লোকসান নেই। তদ্রুপ পরিবারের ছয় সন্তানের একজন হারিয়ে গেলে কিই বা আসে যায়। তাও সে যদি হয় কন্যা সন্তান! সতরাং যোগ-বিয়োগের অংকে আমি নাহয় বাদই পড়লাম।

একটু পরেই বড় সাহেব ডেকে পাঠালেন। তিনি মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করলেন আমার বক্তব্য। তারপর বললেন ব্যাপারটি বড়ই দুঃখজনক। আমি যেন সাবধানে চলাফেরা করি। অফিসের প্রহরীকে অপরিচিত লোকের প্রবেশের পূর্বে যথাযথ অনুমতি প্রার্থনার নির্দেশ দিলেন।

রেহানা সন্ধ্যার পর আবার মহিলা হোস্টেলে আসে। সে একটি সৎ পরামর্শ দেয়। বলে, তুমি যথাশীঘ্র আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ কর এবং সে কাজটি আগামী কল্যই সম্পাদন কর। তুমি তাকে ডিভোর্স দাও। তাতে তোমার অবস্থান দৃঢ় হবে।

নীহারিকা যেন অতল অন্ধকার থেকে জেগে উঠলো। তার অন্তর সায় দিলো। সেদিনকার সেই আকস্মিক ঘটনার সে উতল হয়ে পড়েছিল। বললো, ঠিক বলেছ। আমার বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। আরো আগেই আমার এই পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল।

পরদিন নীহারিকা অফিসে গিয়ে ছুটির জন্য দরখাস্ত দিয়ে, বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে যায় রেহানা। ডির্ভোসের কাগজ-পত্রে স্বাক্ষর করে চলে যায় পুলিশ স্টেশনে। সেখানে সেদিনকার ঘটনার বিবরণ দিয়ে তার ভবিষ্যত নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশংকা ব্যক্ত করে একটি জিডি করে রাখে নাঈম ও তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে।

এর মধ্যে নীহারিকার ছোট বোন এসেছিল একদিন বিকেলে। নীহারিকা তাকে আসতে বারণ করে দিয়েছে। বলেছে, বাড়ির কারো সঙ্গে তার যোগাযোগ রক্ষা করবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে। কারণ সে আর তাদের মত ভাল মেয়ে নয়।

তিনমাস গত হয়। নীহারিকা মিউনিসিপ্যালিটি তেক বিবাহ-বিচ্ছেদের পত্র পায়। ওর বুকের ভিতর যন্ত্রণায় মুচড়ে ওঠে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সে। এই যদি হয় বিয়ের পরিণতি, তবে বিয়ে হয়েছিল কেন? না হওয়াই ভালো ছিলো। তার জীবনের আলোকিত আকাশ বিবাহের কৃষ্ণ মেঘে আচ্ছাদিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল কি? ছিল না। তবুও এসব অবাঞ্ছিত ঘটনা আলো ঝলমলে উৎসবের ভিতর দিয়ে এই মর্মান্তিক, অপমানজক সমাপ্তির পর্দা টেনে দিল। নিজেকে কেমন পরিত্যক্ত, একঘরে মনে হয়। জেলখানার বড় ব অপরাধীরাও হয়ত তার চাইতে সুখী। কারণ তাদের সাজাপ্রাপ্তির কারণ আছে।

বাস্তবতার কাছে এসব চিন্তা অর্থহীন। সে শিক্ষিত মেয়ে। যুক্তিযুক্ত কাজ করার মধ্যে যে মঙ্গল নিহিত আছে- সে বিশ্বাস তার আছে। তাই মন তার স্বচ্ছ, দ্বিধাহীন। সে নির্ভার হয়, মুক্ত এবং স্বাধীন হয়।

বেশ কিছুদিন পর নীহারিকার ছোটবোন আবার আসে। সে জানায় নাঈমের বাবা একদিন এস তার বাবাকে অনেক সমালোচনা করে। তাদের বাবা কোন বিতর্কে যাননি। প্রিয় বাল্যবন্ধুকে তিনি কেবল একটি কথা বলে বিদায় করেছেন। বলেছেন, তুমি একজন দুর্ভাগা পিতা, যে তার সন্তানকে চেনে না। কিন্তু সত্য কোনদিন গোপন থাকে না। চক্ষু কর্ণ খোলা রাখ। একদিন সত্য জানতে পারবে। যদি তখনও তোমার ভিতরে কোন মানুষ জীবিত থাকে তবে আমার সামনে মাথা নত করে দাঁড়াবে। এবার যাও- আর এসো না বৃথা বাক্য ব্যয় করতে।

তার কয়েকদিন পর নাঈমের এক বোনকে সঙ্গে নিয়ে তার পিতা ঢাকায় আসেন ডাক্তারের পরামর্শ নেবার জন্য। প্রথমইে গেলেন ছেলের অফিসে বাসার চাবি নেবার জন্য। গিয়ে দেখেন নাঈম তখনও অফিসে আসেননি। অফিসের লোকেরা তার পরিচয় জানতে পেরে তাকে বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। বড় সাহেব বললেন, নাঈম খুব উশৃঙ্খল প্রকৃতির, ফাঁকিবাজ এবং ইররেগুলার। সে তার ইচ্ছামত অফিসে আসে যায়। সে অফিসের টাকা-পয়সা তসরুপ করেছে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়ের করা হয়েছে। শীগগীরই তকে গ্রেফতার করা হবে। শুনে হার্টের রোগী কাশেম সাহেবের হৃদপিন্ড বিপদ সংকেত দিতে লাগল। তারা তাড়াতাড়ি বাসায় গিয়ে পৌঁছায়। একটি ছোট কাজের ছেলে দরজা খুলে দেয়। ভিতরে বেডরুমে অনেকক্ষণ দরজা নক করার পর আলুথালু বেশে দরজা খোরেন এক অগ্নিশর্মা মহিলা। তিনি ক্রোধে ফেটে পড়েন এবং ঝাঁপিয়ে পড়েন বালকটির উপর। এদের দুজনকে দেখে একটু গিয়ে কর্কশ ভাষায় ধমকে উঠেন। কি চাই? ভিতরে ঢুকেছেন কোন সাহসে? বেরিয়ে যান এখান থেকে। চিৎকার শুনে নাঈম বেরিয়ে আসে। পুত্রকে দেখে পিতা বুঝতে পারেন তিনি ভুল বাড়িতে আসেননি। স্থুলাঙ্গী মহিলাকে নাঈম থামায়। বলে, থামো, আমার আব্বা আর বোন। মহিলা পুনরায় ধমকে উঠেন, এখানে কেন এসেছেন? গোয়েন্দাগিরি করতে? নাঈম তাকে টেনে ভিতরে নিয়ে যায়। অতিদিকে তথাকথিত ড্রয়িং রুমে বসায়।

পিতা এবার বলেন, গত পরশু তোমার সঙ্গে ফোনে আলাপ হয়েছে। তুমি বলেছ নীহারিকা একটি একটি বিশ্বাসঘাতক। যে কষ্ট তোমাকে দিয়ে গিয়েছে, তুমি আর বিয়ের নামও উচ্চারণ আর বিয়ের নামও উচ্চারণ করবে না। এই কি তার নমুনা? এই মহিলা কে? তুমি কি আবার শাদী করেছ? পুত্র বলে, এখন এসব কথা থাক পরে সব বলবো। তখন সেই বব্ কাট হস্তিনী ছুটে আসে আবার। বলে, এখনই বল সব কথা। আজই একটা ফয়সালা হয়ে যাক। নাঈম আমাকে বাদ দিয়ে একটা দুশ্চরিত্র মেয়েকে একেবারে বিয়ে করে নিযে এসেছে। সে গাছেও খাবে তলারও খাবে তলারও কুড়াবে। তা আমি হাতে দিতে পারি না। আর আমি কে, তা আপনার জানবার প্রয়োজন নেই। এখন চলে যান এখান থেকে, যেখান থেকে এসেছেন চলে যান। নাঈম মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

শাবানা বাবাকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে যায়। সেখান থেকে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সেখানে পৌঁছে তার বাবার অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে কয়েকদিন চিকিৎসার পর এখন একটু সুস্থবোধ করছেন। অবিশ্বাস্য সংবাদ শুনে কাশেম সাহেবের বাসার সকলে স্তব্ধ হয়ে যায়।

এসব খবর নীহারিকাদের বাসায় পৌঁছায়। নীহারিকার পিতা ঢাকায় নাঈমের অফিসে ফোন করে সব খবর জানতে পারেন। তারা নাঈমের অসাধু কীর্তিকলাপের অনেক কথাই বললেন।

নীহারিকা চুপ করে থাকে। নীহারিকার পিতা ঢাকায় নাঈমের অফিসে ফোন করে সব খবর জানতে পারেন। তারা নাঈমের অসাধু কীর্তিকলাপের অনেক কথাই বললেন।

নীহারিকা চুপ করে থাকে। অনামিকা বলে, আপা বাসায় চল। আম্মা সারাদিন কাঁদেন তোমার জন্য। নীহারিকা শান্ত কন্ঠে বলে, সীতার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমার জন্য তোমাদের চিন্তা করবার সময় পার হয়ে গিয়েছে। আমি এখন আমার নিজের। তোমাদের কেউ নই। তুমি এখন বাড়ি যাও। আবার বলছি আর এসোনা।

নীহারিকা ভাবে এত বড় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে তার জীবনে- কিন্তু কেন? কোথায় তার ভুল? সে তো কোন ঘটনার জন্য দায়ী নয়। ছোট্ট তটিনীর মত তার জীবন ছুটে যাচ্ছিল, ছন্দে ছন্দে আনন্দে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কোন ত্রুটি নেই, বিচ্যুতি নেই, কোন ঘটনা নেই। মেঘমুক্ত নীল আকাশের মত তার অতীত। তবুও অবাঞ্ছিত ঘূর্ণিঝড় তার বর্তমান ও ভবিষ্যতকে ওলট-পালট করে দিয়ে গেল-যা থেকে মুক্তির কোন উপায় নেই। এসব চিন্তা আর করবেনা বলে উঠে পড়ে সে। এভাবে পরদিনের জন্য কাজ গুছিয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

জীবন চলতে থাকে আপন বেগে গতানুগতিক। এরমধ্যে একটি প্রমোশনও হয়। একদিন একজন সিনিয়র কলিগ করিম সাহেব নীহারিকার সামনে এসে বসেন। দু-চার কথা বলার অনুমতি প্রার্থনা করেন। বক্তব্য হচ্ছে অফিসে এক ভদ্রলোক আছেন, খায়রুল হাসান তার নাম। যিনি কয়েক বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যে থেকে দেশে এসে এ অফিসে চাকুরীতে আছেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের জেষ্ঠ্য সন্তান। আট ভাইবোন তারা। দুর্ঘটনায় পিতৃহীন হয়ে পড়ায় বড় ভাইকে ধরতে হয় সংসারের হাল। প্রথমে সে পিতার অফিসে চাকুরী গ্রহণ করে। এরই মধ্যে এম, এ পাশ করে। তারপর ভাগ্যাণ্বেষণে বিদেশে পাড়ি জমায়। এভাবেই ভাই-বোনদের মানুষ করার কাজে ব্রতী হয়। ভাইবোনের আজ প্রত্যেকে শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত। খায়রুল হাসান মাকে নিয়ে কুমিল্লায় থাকেন। তিনি অকৃতদার। সময়মত সংসার পাতার কাল অতিক্রম করে এসেছেন অনেক আগেই।

করিম সাহেব আরো বলেন, আপনি তাকে দেখছেন অনেকদিন ধরেই। আমরা চাই তিনি সংসারী হোন। কারণ মানুষ নিঃসঙ্গ থাকতে পারে না। তিনি এখন অনেকটা রাজি হয়েছেন। আপনিও একটু নিজের কথা ভাবুন। কোন একটি দুর্ঘটনাকে ধরে রেখে জীবন কাটানো ঠিক নয়। প্রত্যেক মানুষরই একটি নিজস্ব সঙ্গী ও আবাসস্থল থাকা চাই। কোথাকার কোন দুর্বৃত্তের স্মৃতি সারাজীবন ধরে বহন করার প্রয়োজন কি? একটু ভেবে দেখবেন। অফিসে আমরা প্রত্যেকে আপনার হিতাকাঙ্খী। আমরা সকলেই এ ব্যাপারে অনেক ভেবে একমত হয়ে আপনার কাছে এসেছি।

খুব চিন্তায় পড়ে যায় নীহারিকা। বড় এক অনুভব করে সে। একটা কেউ নেই যে তার চিন্তা ভাবনার অংশীদার হতে পারে। রেহানার কথা মনে পড়ে। ওর সঙ্গে যোগাযোগ নেই অনেকদিন। ফোন করে বলে খুব শীগগীরই ওর হোস্টেলে আসার জন্য। পরদিন সন্ধ্যায় রেহানা এসে হাজির হয়। নীহারিকাকে খুব বিমূর্ষ দেখায়। কুশল বিনিময়ের পর নীহারিকা তার মানসিক উদ্বেগের কথা জানায়। রেহানা সব বৃত্তান্ত শুনে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে। তারপর বলে প্রস্তারের পক্ষেই আমার মত। এর চাইতে ভাল এ মুর্হূতে আর নেই। ভদ্রলোক নির্ঝঞ্জাট। সে তোমার অচেনা নয়। তাকে তুমি ভাল লোক বলে জান। সুতরাং মনস্থির করে ফেরতে পার। তোমার অন্তর যদি ‘হ্যাঁ’ বলে তবে কোন অজ্ঞাত কারণে না বলো না। এই আমার অভিমত। তুমি অনুমতি দিলে আমি তোমার পক্ষে কাজ করতে পারি। নীহারিকা সম্মতি জ্ঞাপন করে।

রেহানা খায়রুল হাসানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। সরাসরি তার মতামত জানতে চায়। তিনি দ্বিধাগ্রস্ত এই কারণে যে নীহারিকার মত একজন দক্ষ এবং বুদ্ধিমতি মেয়ে তাকে পছন্দ করবে কিনা। শেষে সব দ্বিধার অবসান ঘটিয়ে তিনি রাজী হন। আনুষ্ঠানিক বিয়েতে নীহারিকার সম্মতি ছিল না। কিন্তু সকলের অনুরোধ বন্ধু রেহানা তার নিজের বাসায় সব আয়োজন করে। এখান থেকে কনে বিদায় হয়। খায়রুল হাসানের পরহেজগার মাতা নীহারিকাকে নিজের মেয়ের মত ঘরে তুলে নেন। সে বাড়িতেও একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠান হয়। অফিসের কলিগরা খুশী হন।

ছোট্ট সাজানো সংসার নীহারিকার ভাল লাগে। খায়রুল হাসান ও তার মা দুজনেই খুব উদার মনের মানুষ। একটা আদর্শকে সামনে রেখে পথ চলেন তারা। মনে পড়ে যায় নিজের ময়ের কথা। কত শখ করে তিনি একটি নাম সেই সুদূর মহাকাশে নক্ষত্রমন্ডল হতে আহরণ করেছিলেন কন্যার জন্য। গড়েও তুলেছিলেন অনন্য সাধারণ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টর্নেডো-ঝঞ্জার কবলে পড়ে কোথায় হারিয়ে গেল। আবার হয়ত কোনদিন মেঘমুক্ত নভঃমন্ডলে গভীর অন্ধকারে নীহারিকা নামের নক্ষত্রপুঞ্জ আলোক সজ্জায় সজ্জিত হয়ে দৃশ্যমান হবে।